আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
মঙ্গলবার, ১৩ আগষ্ট ২০২৪ ইং ০৫:০০ পিএম.
কুড়িগ্রামের নয়টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি)। প্রতিষেধক না থাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোগটিতে অনেকের গরু মারা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষক ও খামারিরা। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, নয়টি উপজেলায় গরুর সংখ্যা ৯ লক্ষাধিক। তবে এ রোগে কী পরিমাণ গরু মারা গেছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য তাদের কাছে নেই। বিভিন্ন ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক মাসে জেলায় দুই শতাধিক গরুর মৃত্যু হয়েছে। রোগটি প্রতিরোধে লিফলেট বিতরণ ও প্রচারণা চালিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
স্থানীয় কৃষক ও খামারিরা বলছেন, গরুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে চামড়ায় গুটি গুটি দেখা যাচ্ছে। গলা ও পা ফুলে পানি জমছে। শরীরে বইছে জ্বর ও প্রচণ্ড ব্যথায় শরীর বেঁকে যাচ্ছে। নাক, মুখ দিয়ে ঝরছে লালা। ঠিকমতো খেতে না পারায় দুর্বল হয়ে অনেক গরু মারাও যাচ্ছে। জেলার সদর, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকের আয়ের একমাত্র উৎস গরুর খামার। প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামারিদের রোগ সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকায় গ্রাম্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন। তবে তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রাম ও চরাঞ্চলের বেশির ভাগ বাড়িতেই গরু লালন-পালন করেন কৃষক। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ২-১০টি গরু। হঠাৎ লাম্পি স্ক্রিন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা।
সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের বাসিন্দা আকরাম বলেন, ‘আমার পাঁচটি গরু রয়েছে। এক মাস আগে একটি বাছুরের শরীরে হঠাৎ গুটির মতো কিছু দেখতে পাই। পরে স্থানীয় পশু চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ ও পরামর্শ নিয়েছিলাম। আরো দুটি গরু একই রোগে আক্রান্ত হয়। একপর্যায়ে গরুর রুচি কমে যায় এবং একটি গরু দুর্বল হয়ে মারা যায়।’
রাজারহাট উপজেলার উমর মজিদ ইউনিয়নের বালাকান্দি গ্রামের রতন মিয়া জানান, তার একটি গরুর ডান দিকে পেটের চামড়ায় কয়েকটি গুটি উঠে রক্ত বের হচ্ছে। ১০ বছর ধরে বাড়িতে ৮-১০টি গরু পালন করছেন তিনি। আগে এমনটা হয়নি। এবার হঠাৎ এমন হওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের প্রাণিসম্পদ বিভাগের তালিকাভুক্ত ভ্যাকসিনেটর ইন্দ্রমোহন মণ্ডল মধু জানান, এ ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে লাম্পি স্কিন রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা চিকিৎসা দিচ্ছেন। কিছু গরু ভালো হলেও এক মাসে ১০টি বেশি গরু মারা গেছে।
পশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯২৯ সালে সর্বপ্রথম আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়ায় রোগটি দেখা দেয়। ১৯৪৩-৪৫ সালের মধ্যে মহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। মশা-মাছিবাহিত রোগটি মূলত মশার মাধ্যমেই বেশি ছড়ায়। আক্রান্ত গরু সুস্থ হতে দীর্ঘদিন সময় লাগে। দিন দিন গরু-বাছুর দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে মারাও যায়। একটি খামারকে অর্থনৈতিকভাবে ধসিয়ে দিতে খুরা রোগের চেয়েও বেশি ভয়ংকর এটি।
বাংলাদেশে গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রথম দেখা দেয় ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে। এরপরই মাঠে নামে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তদন্ত টিম। তখন দেশের ১২ জেলায় ৪৮ হাজার গরুর মধ্যে এ রোগের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। মূলত এটি পক্স ভাইরাস বা লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাসজনিত রোগ। ছাগল ও ভেড়ার পক্স ভাইরাসের সঙ্গে এর মিল পাওয়া যায়। এ ভাইরাস গরু ছাড়া মহিষেও ছড়াতে পারে। এক গরু থেকে আরেক গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। ছাগল ও ভেড়ায় প্রতিলিপি তৈরি করলেও এরা সাধারণত লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয় না। এছাড়া এ ভাইরাস মানুষকে আক্রমণ করে না। রোগটি প্রধানত বর্ষার শেষে, শরতের শুরু বা বসন্তের শুরুতে মশা-মাছির বেশি বিস্তারের সময় ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
তবে এ রোগের চিকিৎসা সহজ নয়। আগে রোগটির আক্রমণ হলেও এর ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয়। তবে খামারের ভেতর এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে মশা-মাছির উপদ্রব কমিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রান্ত গরুর খামারের শেড থেকে আলাদা করে অন্য স্থানে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখলে অন্য গরুতে সংক্রমণ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আক্রান্ত গাভির দুধ বাছুরকে খেতে না দিয়ে মাটিচাপা দেয়া উচিত।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোনাক্কা আলী বলেন, ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ একটি ভাইরাসজনিত রোগ। মূলত কীটপতঙ্গের কামড়ে অসুস্থ গরু থেকে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। কুড়িগ্রাম জেলার কিছু জায়গায় এ রোগ দেখা দিয়েছে। যাদের গরু আক্রান্ত হয়েছে, আর যাদের আক্রান্ত হয়নি, তাদের সচেতনতার জন্য আমরা লিফলেট বিতরণ করছি। সুস্থ গরুগুলোকে রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। রোগটি যাতে আর বেশি ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য প্রতিটি উপজেলায় মাঠ পর্যায়ে বৈঠকের পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।’
Leave a Reply