আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪ ইং ০৭:৫৯ পিএম.
কৃষিপুঞ্জি অনুযায়ী খরিফ-২ মৌসুমে রোপা আমন, শাকসবজি, মাষকলাইসহ অন্যান্য ফসল চাষের জন্য সাধারণ জমি প্রস্তুত করার কাজ হয় জুলাই মাসের শুরু থেকে। কিন্তু অভিন্ন নদ ব্রহ্মপুত্রসহ ১৬টি নদ-নদীর পানিতে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের অর্ধেকটাই প্লাবিত। ফলে বেকার হয়ে আছেন কমপক্ষে ২ লাখ কৃষিশ্রমিক। সবজি, মরিচ, পাটসহ বিভিন্ন ফসল বন্যায় নষ্ট হওয়ায় অন্তত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে কৃষিনির্ভর প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আরও জানান, বন্যার পানিতে ৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির পাট ও মরিচসহ নানা ধরনের ফসল নষ্ট হয়েছে। বন্যা-উত্তর কৃষি পুনর্বাসনে চাষাবাদে অগ্রাধিকার পাবে রোপা আমন, শাকসবজি, মাষকলাই এবং শীতের আগাম ফসল যেমন সরিষা।
অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হবে। খরিফ-২ মৌসুমের জন্য চাষিদের জমি তৈরির কাজ এ বছর শুরু হতে দেরি হবে। কারণ বন্যায় ডুবে আছে অনেক জমি।’
কুড়িগ্রামে কত পরিবার কৃষির ওপর নির্ভরশীল- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কৃষি বিভাগের হিসাবে বলা হয়েছে ৫ লাখ ৮ হাজার পরিবার কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তার মধ্যে অন্তত আড়াই লাখ পরিবারেই আছেন কৃষিশ্রমিক। বন্যায় তাদের অনেকেই এখন বেকার।’
তার দাবি, পানি নেমে গেলেই কাজ পাবেন বেকার কৃষিশ্রমিকদের অনেকেই। কারণ খরিফ-২ মৌসুমের জন্য জমি তৈরির কাজ শুরু করবেন চাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যায় শতভাগ নষ্ট হয়ে গেছে ৫৫৪ হেক্টর বীজতলার পাশাপাশি ৩৭ হেক্টরের মরিচ, ১ হাজার ১৭০ হেক্টর জমির আউশ আর ৭৩৭ হেক্টর জমির শাকসবজি। তবে কুড়িগ্রামের অন্যতম অর্থকরী ফসল পাটের তেমন ক্ষতি হয়নি এ পর্যন্ত। পানি নেমে যাওয়ার পরই ৪ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমির পাট কাটা শুরু হবে।
কথা হয় কৃষিশ্রমিক মো. মহসিন আলীর সঙ্গে। বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ইত্তর নবাবাস গ্রামে। দুই দফা বন্যা তাকে প্রায় নিঃস্ব করে ছেড়েছে। প্রথম দফা বন্যার পর থেকেই তিনি প্রায় বেকার। প্রথম বন্যার আগে তিনি দিনে গড়ে রোজগার করতেন ৫০০ টাকা। বন্যায় তার অবস্থা কী- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘৯ সদস্যের পরিবার চালাতে গিয়ে গত ছয় মাসে দেনা করেছি প্রায় এক লাখ টাকা। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, ধারও কেউ দিতে চায় না।’
তার আফসোস, পানি নেমে যাওয়ার পর আবার কাজ করার সুযোগ হলেও ধারের টাকা শোধ করতেই বড় অঙ্ক চলে যাবে। এ অবস্থায় পরবর্তী দিনগুলো আরও কঠিন হবে।
যেসব এলাকা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে নাগেশ্বরী উপজেলা একটি। কুড়িগ্রামের এ উপজেলার অনেকটা এলাকা এখন ফসলসহ পানিতে ডুবে আছে। ডুবে থাকা জমি দেখতে এসেছিলেন বর্গাচাষি মো. আব্দুস সাত্তার। পূর্ব নাগেশ্বরী বয়লার ডাবা গ্রামের এ চাষি নিজের জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতেও শ্রম দেন। জানালেন, দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে এ বছর তিনি যে ফসল চাষ করেছেন, তার পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে বন্যায়। কেমন আছেন?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রায় এক মাস ধরে বেকার বসে আছি। প্রথম বন্যার আগে দিনে আমার রোজগার হতো ৪০০-৫০০ টাকা। আর এখন ধারদেনা করে চলছি।’
তিনি জানান, হাতে কোনো টাকা-পয়সা না থাকায় গত সপ্তাহের বাজার করেননি। পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটার টাকা না থাকায় সকালে বাড়ি থেকে বের হন আর রাত দুপুরের পর কখনো কখনো আরও পরে বাড়িতে ফেরেন।
একই এলাকার আরেক কৃষিশ্রমিক মো. নজরুল ইসলাম। তিনিও বেকার অনেক দিন। আট সদস্যের পরিবার কীভাবে চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে চলছি। কত দিন বেকার?
তিনি বলেন, ‘প্রায় এক মাস ধরে পুরোপুরি বসে আছি। কোনো কাজ নেই। সংসার চালাতে গিয়ে ইতোমধ্যেই ধার করেছি ১৫ হাজার টাকা। বন্যার পানি পুরোপুরি নামতে সময় লাগবে কমপক্ষে ১৫ দিন। তাতে আমার দেনা বাড়বে আরও অন্তত ১০ হাজার টাকা।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জুনের শেষ দিকে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। জুলাইয়ের শুরুতে বিপৎসীমা অতিক্রম করে ওই নদ। এখনো ওই নদের পাশাপাশি বিপৎসীমার ওপর আছে ধরলা ও দুধকুমার। বৃষ্টি কম হওয়ায় উজানে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু তারপরেও ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি কমতে আরও সময় লাগবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বন্যার ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন অন্তত ২ লাখ কৃষিশ্রমিক। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কমপক্ষে ৫০ হাজার কৃষিনির্ভর পরিবার। দুই দফা বন্যায় মরিচ, পাট, রোপা আমনের বীজতলা ও সবজিসহ নানা ধরনের ফলন নষ্ট হয়েছে অন্তত ৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির। এতে চাষিদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা।
Leave a Reply